১. জনসংখ্যা সমস্যা ও প্রতিকার

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - পৌরনীতি ও নাগরিকতা - নাগরিক সমস্যা ও আমাদের করণীয় | | NCTB BOOK
1

১. জনসংখ্যা সমস্যা ও প্রতিকার:

 

জনসংখ্যা সমস্যা কী ?

একটি দেশের সম্পদ ও কর্মসংস্থানের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি হলে তখন জনসংখ্যা ঐ দেশের জন্য সমস্যায় পরিণত হয়। কারণ, বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা দেশের সীমিত সম্পদ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব হয় না । বর্তমানে জনসংখ্যা সমস্যা বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। তবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে কোনো কোনো দেশের জন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। এজন্য বলা হয়ে থাকে যে, শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধিই সর্বত্র সব সমস্যার জন্য দায়ী নয় ৷ 

 

বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যার চিত্র:
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীতে ৮ম এবং এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৫ম স্থানে অবস্থান করছে । এদেশের আয়তন মাত্র ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ১৫ কোটি। আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যার পরিমাণ বেশি। বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটার জায়গায় ১১০০ জন লোক বাস করে, যেখানে চীনে ১.৪ বিলিয়ন লোকসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১৪০ জন লোক বাস করে আর ভারতে ১.২ বিলিয়ন লোকসংখ্যা সত্ত্বেও প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৩৬২ জন বাস করে ।

২০১১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭। অধিক জনসংখ্যা বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। সীমিত সম্পদের কারণে দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ করা সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। শহরে ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে চাহিদা অনুযায়ী সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। গ্রামে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় সেখানকার বেকার মানুষ শহরে পাড়ি দিচ্ছে। এছাড়া আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আবাদী জমিতে এবং বনভূমি কেটে বসতি গড়ে উঠছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলে খাল-বিল, নদী-নালা ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতসব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার মাধ্যমে এই সমস্যাকে সম্ভাবনায় পরিণত করছে । কিন্তু মোট জনসংখ্যার তুলনায় তা এখনো যথেষ্ট নয় ।

 

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ:
১. জলবায়ুর প্রভাব : বাংলাদেশ গ্রীষ্মমণ্ডলে অবস্থিত। তাই এদেশের জলবায়ু উষ্ণ। উষ্ণ জলবায়ুর প্রভাবে এখানকার ছেলেমেয়েরা অপেক্ষাকৃত কম বয়সে প্রজনন ক্ষমতার অধিকারী হয় । ফলে এখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি ।

২. বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ : বিবাহ আমাদের দেশে একটি ধর্মীয় ও সামাজিক কর্তব্য বলে মনে করা হয়। এ কর্তব্যবোধ ছাড়াও অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে দেশে বাল্যবিবাহ প্রচলিত। কম বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে তাদের সন্তান-সন্ততির সংখ্যা বৃদ্ধি পায় । এছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন পুরুষ একাধিক বিয়ে করে । বিশেষ করে অল্প আয়ের পরিবারগুলোতে এ প্রবণতা বেশি থাকে। এভাবে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের ফলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ।

৩. দারিদ্র্য ও আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা : সাধারণভাবে সচেতনতার অভাব ও অধিকতর আয়ের প্রত্যাশায় দরিদ্র মানুষ অধিক সন্তান জন্মদান করে থাকে। এছাড়া কেউ কেউ মনে করেন যে, পুত্র সন্তান বৃদ্ধ পিতামাতাকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে সক্ষম। অধিক নিরাপত্তার আশায় তাঁরা একাধিক পুত্র সন্তান কামনা করেন । ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় ।

৪. শিক্ষার অভাব : শিক্ষার অভাব ও অজ্ঞতার কারণে ছেলেমেয়েদের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান সম্বন্ধে চিন্তাভাবনা না করেই আমাদের দেশের মানুষ অধিক সন্তান জন্ম দিয়ে থাকে । ফলে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে । 

৫. সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি : সামাজিক মর্যাদা এবং শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনের জন্য বিয়ে একটি অপরিহার্য বিষয় বলে মনে করা হয়। বিশেষভাবে কন্যা সন্তানের সামাজিক নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে দ্রুত বিয়ে দেওয়ার প্রবনতা আমাদের সমাজে বিদ্যমান। এতে করে জনসংখ্যা অধিক হারে বেড়ে যায়। আমাদের দেশের অধিকাংশ বাবা-মা ছেলেমেয়ে বড় হলে বিয়ে না দিলে কখন, কোথায়, কোন সামাজিক অপরাধ করে বসবে এই ভয়ে ভীত থাকে । এই ভয় এবং সমাজের চোখে হেয় হওয়ার আশঙ্কায় তারা দ্রুত ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে বিপদ এড়াতে চেষ্টা করে। এতে করে জনসংখ্যা অধিক হারে বেড়ে যাচ্ছে ।

৬. সচেতনতার অভাব : ছোট পরিবার সুখী পরিবার-এরূপ সচেতনতার অভাব আমাদের দেশে বেশি। তাছাড়া পরিবার পরিকল্পনার সুবিধাদির অভাব থাকায় এবং এ ব্যাপারে সচেতন না হওয়ার কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের উপায় : সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ:

দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে বহুবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপক জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে না পারলে দেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা যেতে পারে ।

১. জনসংখ্যার পুনর্বণ্টন : বাংলাদেশের সর্বত্র জনসংখ্যার অবস্থান একই রকম নয় । কাজেই যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব খুব বেশি সেখান থেকে অল্প ঘনত্ব এলাকায় জনসংখ্যা সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে জনসংখ্যা পুনর্বণ্টন করতে হবে । এতে জনগণের কর্মসংস্থান হবে আর জীবনযাত্রার মানও বেড়ে যাবে ।

২. জনশক্তি রপ্তানি : দেশের যুব সমাজকে প্রযুক্তি ও দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, দূরপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও পাশ্চাত্যের উন্নত দেশে প্রেরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রায় আয় বাড়বে ও বেকারত্ব দূর হবে । সরকার এ বিষয়ে ইতোমধ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ।

৩. কর্মসংস্থান বৃদ্ধি : জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেলে জনগণের আয় ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া মানুষকে কাজ দিতে পারলে এবং অভাব থেকে মুক্ত করতে পারলে তারা নিজেরা আত্মসচেতন হবে এবং দায়দায়িত্ব বুঝতে পারবে ।

৪. শিক্ষার প্রসার : শিক্ষা মানুষকে সচেতন করে । শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সচেষ্ট থাকে । ছোট পরিবারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে শিক্ষিত পরিবার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনে ।

৫. অর্থনৈতিক উন্নয়ন : কৃষির উন্নয়ন, শিল্পের উন্নয়ন, উন্নত বাজার সৃষ্টি এবং উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত করতে হবে। উচ্চ ফলনশীল ফসল আবাদ, একই জমিতে একাধিক ফসল চাষাবাদ করতে হবে । কাঁচামাল তৈরি করে শিল্প গড়ে তুলতে হবে । কুটির শিল্পের তৈরি মালামাল দিয়ে বৃহৎ শিল্প গড়ে তুলতে হবে । কৃষিজাত দ্রব্য ও শিল্পজাত দ্রব্য যাতে ন্যায্যমূল্যে ও সহজে বিক্রি করা যায় তার জন্য বাজার এবং যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। এসব করতে সক্ষম হলে জনসংখ্যা সমস্যা না হয়ে জনসম্পদে পরিণত হবে ।

৬. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা : উচ্চ জন্মহার রোধ করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট'–এই শ্লোগানকে কার্যকর করার জন্য সরকারকে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে । পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে অধিক হারে মাঠকর্মী নিয়োগ করতে হবে । জন্মনিয়ন্ত্রণের ঔষধপত্র সহজলভ্য করতে হবে এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সেবা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্লিনিক গড়ে তুলতে হবে । তাছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে গণসচেতনতা বৃদ্ধি পাবে ।

৭. জনসংখ্যানীতি গ্রহণ : ১৯৭৬ সালের জনসংখ্যানীতিকে আরও সংস্কার করে ২০০৪ সালে সরকার নতুন জনসংখ্যানীতি গ্রহণ করে । এই নীতির আওতায় সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে । এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির ব্যবহার বৃদ্ধি করে দেশে প্রজনন হার হ্রাস করা, পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক শিক্ষামূলক কর্মসূচী গ্রহণ করা এবং এ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য সেবা সহজলভ্য করা। পাশাপাশি কিশোর-কিশোরীদের সচেতন করার জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে তথ্য, উপদেশ ও সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা; গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে জন্মনিয়ন্ত্রণের সুফল সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা; নারী-পুরুষের সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সহায়তা করা। মেয়েদের ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছরের পূর্বে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হওয়া। জনসংখ্যানীতির এসব দিক বাস্তবায়ন করতে হবে।

৮. সুবিধাবঞ্চিতদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধকরণ : বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে জনসংখ্যা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সেবাবঞ্চিত এলাকাসমূহে সেবার মান উন্নত করতে হবে এবং গরিব ও দুস্থদেরকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের একসাথে কাজ করতে হবে ।

 

জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানে নাগরিক হিসেবে আমাদের করণীয়:

বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ জরুরি। সচেতন নাগরিক হিসেবে জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখা সকলের নাগরিক দায়িত্ব । প্রথমত, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল সম্পর্কে নাগরিক হিসেবে আমরা নিজেরা সচেতন হতে পারি এবং অন্যকেও সচেতন করতে পারি । দ্বিতীয়ত, আমাদের বা প্রতিবেশী পরিবারে কোনো নিরক্ষর শিশু বা ব্যক্তি থাকলে তাদেরকে আমরা শিক্ষার সুযোগ দিয়ে উৎসাহিত করতে পারি, যাতে সে জনসম্পদ হয়ে গড়ে উঠতে পারে। সম্পদের তুলনায় অধিক জনসংখ্যা শুধু পরিবার নয় রাষ্ট্রের ও জাতির জন্যও বোঝা । তবে যুগোপযোগী শিক্ষা ও সচেতনতার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে পারলে তা জাতির জন্য সম্পদে পরিণত হবে।

Promotion